ডেলিভারিম্যান (গল্প)
আচ্ছা আকাশ কি স্ত্রীলিঙ্গ না পুংলিঙ্গ! পুংলিঙ্গই হবে হয়তো।একজন পুরুষ এভাবে সারাদিন ফ্যাচফ্যাচে কান্না করে কি করে! বড় বিরক্তিকর। আপাদমস্তক ভিজে একাকার রাজীব। এক মুহূর্ত কি ভেবে থেমে গিয়ে বাঁ হাতে ধরে রাখা খাঁচাটার দিকে তাকায়। পাখিটা এত চুপচাপ হল কি করে। আচ্ছা টিয়া পাখিদের কি ভিজলে ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বর জাতীয় কিছু হয়! কিছুক্ষন আগেও এটা যখন অন্য হাতে ছিল শুধু ঘুরে ঘুরে লাফাচ্ছিল আর ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ডাকছিল। কাকে ডাকছিল আর কি যে বলছিল কে জানে! টিয়া পাখির ভাষা যদি জানা যেত খারাপ হত না। গোয়েন্দা হিসেবে বেশ ভালোভাবে কাজে লাগানো যেত কিংবা খবর-আদান প্রদান…রাজীব ভাবতে ভাবতে দেখে একটা ফ্রক পড়া মেয়ে পাঁচতলা বাড়ীটার গেইট দিয়ে উঁকি দিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে দূরে গলির দিকে। রাজীব আর দেরী করে না। মেয়েটার সামনে গিয়ে ওপরে বিল্ডিঙটাকে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়। তার আশপাশের বিল্ডিং গুলো ও পরখ করে নেবার ভান করে।
- আচ্ছা গোলাম মাওলা সাহেবের বাড়ী কোনটা? ব্যাংকার।
- এটা। আপনি কে?
- আমি কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার থেকে …চলুন ভেতরে যাই।
ফ্রক পড়া মেয়েটা কিছু বলবার আগেই রাজীব এগিয়ে যায়। মেয়েটা সরে দাঁড়ায়। রাজীব অনুমান করার চেষ্টা করে মেয়েটা কি তাহমী? আচ্ছা সিওর হয়ে নেয়া যাক।
- ওনার বাসা কতালা?
- আসুন। দ্বিতীয় তালা। আপনার হাতে এটা কি?
মেয়েটার সাথে সাথে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে রাজীব। হাতে ধরে রাখা খাঁচাটা উঁচিয়ে দেখে নিয়ে হেসে জবাব দেয়
- এটা একটা পার্সেল। আমি কুরিয়ার ম্যান। কি নাম আপনার?
- তাহমী।
রাজীব বুঝতে পারে মেয়েটি ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া ছোট বোনটি । দোতালার ডান পাশের দরজা খোলাই ছিল। পাখি হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে সে।
- বাসায় বড় কেউ নেই? একটু পাঠিয়ে দাও
তাহমীর বিস্ময় ভাব টা কাটে না। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে পাখিটার দিকে তাকায়। তারপর কি ভেবে রাজীব কাম কুরিয়ার ম্যানের দিকে তাকিয়ে ভেতরের দিকে চলে যায়।
রাজীব চশমা খুলে মোটা কাঁচের পানি মুছে নেয়। তাতে লাভের লাভ কিছুই হয় না। সব সময় লাভ বুঝে সব কাজ করা চলে না। গুনগুন করে কিছু একটা গানের সুর ভাঁজতে থাকে আনমনে। না আনমনে না আসলে সচেতন ভাবেই। তাতে যদি নার্ভাসনেস ভাবটা কাটানো যায় ক্ষতি কি! না কাজের কাজ কিছুই হয় না। পা বোধহয় কিছুটা কাঁপছে। চুল গড়িয়ে পানি পড়ছে। অনেকক্ষণ হলো কেউ আসছে না। ভাবতেই তিনজন প্রায় হা করে থাকা কিশোরী কাম তরুণী এসে দাঁড়ায় ভেতর দরজার সামনে। রাজীব মুহূর্তে নার্ভাসনেস কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়। চশমাটা চট করে চোখে পড়ে নেয়। এবার পরস্কার দেখা যাচ্ছে। ডান পাশে ফ্রক পড়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটা তাহমী । তার পাশেরজন …উম্মম না রাজীব বুঝতে পারে না তরুণীটির নাম কি। কে হতে পারে সোমা নাকি সীমা! ঠিক বুঝতে পারছে না কোন জন। আচ্ছা বড় বোনের নাম যেন কি! না গুলিয়ে যাচ্ছে নাম। তার বাঁ পাশে …বর্ণনার সাথে অমিল না হলে এ হচ্ছে নাইমা।
রাজীব পাকা কুরিয়ার ম্যানের মত হাতে ধরে রাখা খামটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে
- আপনাদের এখানে রিফাত সুলতানা নাইমা কে?
বাঁ পাশের সুন্দরী ষোড়শী হঠাত প্রায় ইলেকট্রিক শক খাবার মতো করে লাফিয়ে উঠে । ভুল হল ষোড়শী হবে না।
- জ্বী আমি!
নাইমার চোখ ছানাবড়া। কুরিয়ার ম্যানের হাতে ধরে রাখা খাঁচাটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। তারপর পাশের জনের দিকে তাকায়। বাকি দুজন নাইমার দিকে তাকিয়ে পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অদ্ভুত দর্শন ভিজে যাওয়া তরুণটির দিকে একসাথে ফেরে তিনটি মুখ । খাঁচার মধ্যে টিয়া পাখি ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরছে। মাঝের তরুণী আপাদমস্তক তরুণটিকে দেখে নেয়। তাদের মাথায় যেন কিছুই ঢোকে না। মাঝখানের তরুণী কথা বলে উঠে
- আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।
- জ্বী আমাকে তো চিনবার কথা না। আমি কুরিয়ার ম্যান।
রাজীব আত্মবিশ্বাসের সাথে চটপটে উত্তর দেয়। তরুণীটির তাকানোর মধ্যে কিছু একটা ঘোর যেন আছে। সন্দেহ আর বিস্ময় দুচোখে তার। জেরা করার ছলে জিজ্ঞেস করে-
- আপনি কোত্থেকে আসছেন?
- জ্বী আমি নিও মার্কেট কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিস থেকে এসেছি।
- আপনি…আপনি কি ডেলিভারি ম্যান?
- জ্বী আমাদের অফিসে ৪ জন ডেলিভারী ম্যান এবং ৬ জন ডেস্ক স্টাফ। ২জন আজ ছুটিতে আছে। তাই আমার কাজ আজ বেশী।
ডেলিভারী ম্যান এত সুন্দর বাচন ভঙ্গিতে কি কথা বলে! তাছাড়া সু... না কনফিউশান লাগছে তরুনীর। আরেকটু বাজিয়ে নেবার চেষ্টা করতে থাকে
- আপনারা কি কি সার্ভিস দেন?
- আমরা যে কোন ধরনের অফিসিয়াল ডেলিভারি থেকে শুরু করে পার্সোনাল ডকুমেন্টস সহ এভ্রি কাইন্ড অব গুডস অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে হোম ডেলিভারী দিয়ে থাকি। …কই রিফাত সুলতানা আপনি এখানে একটা সাইন করুন প্লীজ!
ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল।
- আচ্ছা আসি। এটা পৌঁছে দেয়া আমার দায়িত্ব। আমি তো ফেরত নিয়ে যেতে পারবোনা।
রাজীব খাঁচাসুদ্ধ পাখিটা দরজার কাছে রেখে সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত নেমে যায়।
নাইমার কাছ থেকে রিসিভিং কপিটা তরুনী নিয়ে নেয়। সেন্ডিং এড্রেসের জায়গায় লেখা শুধু “রিফাত সুলতানা নাইমা , C/O- গোলাম মাওলা, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার “ !!
শুধুমাত্র এইটুকু এড্রেস দিয়ে বাসা চিনে পার্সেল পৌঁছে দেয়া যায়! তরুণীটির রাগে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে থাকে। পাশের জনের হাত থেকে খাম টি এক ঝটকায় কেড়ে নেয়। খাম ছিড়ে সাদা কাগজ টেনে বের করে ভাঁজ খুলতে থাকে।
তিনজনই ঝুঁকে পড়ে সাদা কাগজের উপর। বিস্ময়ের সীমা থাকে না কারো। বাই দি বাই, তরুণীটির নিক নেইম “সীমা “ যার রাগের কোন পরিসীমা থাকে না সাদা কাগজের মাঝখানের লেখাটুকু পড়ার পর।
“HAPPY BIRTH DAY NAIMA…”
নাইমা সেদিন ষোড়শী। না ভুল হল সেদিন থেকে সপ্তদশী!
পাখিটা ঘুরে ঘুরে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করতে থাকে অন্যদিকে যারপরনাই অস্থির অপ্রাসঙ্গিক এক চরিত্র জনৈক ক্যাবলাকান্ত রাজীবের সামনে ধূমায়িত চা বাড়িয়ে দেয়। রাজীব চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে যায়। বাইশ বছরের নায়ক চরিত্রটি বুকের ঢিপঢিপ শব্দ ছাপিয়ে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চশমা পড়া করিতকর্মা সব্যসাচীর দিকে।
- কই...কই আমার সিগারেটের প্যাকেট কই!!
চশমার মোটা কাঁচের ভেতর থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাজীব দি কুরিয়ার ম্যান!
- অই মামা... এক প্যাকেট গোল্ডলিফ! জলদি মামা!
ঢিপঢিপ ক্যাবলাকান্ত খান দাঁত বের করে ঘটনা শোনবার জন্য ভেলিভারি ম্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবতে থাকে বৃষ্টিটা ফ্যাচফ্যাচে হলেও দিনটা অদ্ভুত সুন্দর। তার মনে হতে থাকে প্রকৃতি তানপুরা হাতে সুর ধরেছে সকাল থেকেই।
মন্তব্যসমূহ